মিউনিখে ফরাসি বিপ্লব! ইতিহাস গড়ে চ্যাম্পিয়ন পিএসজি, ইন্টারকে উড়িয়ে ফ্রান্সে ফিরল ইউরোপ সেরার মুকুট
৩২ বছর পর ইউরোপ সেরা হলো ফ্রান্স। আর সেই সাফল্য এনে দিল প্যারিস সঁ জরমঁ (পিএসজি)। লুইস এনরিকের কোচিংয়ে এক অনবদ্য দলীয় পারফরম্যান্সে মিউনিখে উড়ে গেল ইন্টারের সব আশা। ৫-০ গোলের এক অভূতপূর্ব জয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল পিএসজি। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ইতিহাসে এত বড় ব্যবধানে জয়ের নজির এই প্রথম। আর এই জয় যেন ইউরোপের ফুটবলে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা।
তিন দশক আগের স্মৃতি আর পুনর্জন্মের গল্প
১৯৯৩ সালে মার্সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল মিউনিখেই। সেই ছিল ফরাসি ক্লাবের প্রথম এবং এতদিন পর্যন্ত একমাত্র ইউরোপজয়। ৩২ বছর পর, সেই একই শহরে ফিরে এসে ইতিহাস লিখল পিএসজি। এই জয় শুধুমাত্র একটি ট্রফি নয়—এ এক জাতীয় গর্বের মুহূর্ত।
লুইস এনরিকের পরিকল্পনার জয়
বার্সেলোনার কোচ হিসেবে ২০১৫ সালে ট্রেবল জয়ী লুইস এনরিকে পিএসজি কোচের দায়িত্ব নিয়ে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিলিয়ান এমবাপে, লিওনেল মেসি, নেইমার—বড় নামদের ছেড়ে দিয়ে তিনি গড়েছেন এক নতুন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল ও ঐক্যবদ্ধ দল। তারকাখচিত নয়, বরং পরিকল্পনাধর্মী ফুটবলই ছিল এনরিকের মূলমন্ত্র। তিনি জানতেন, দলে প্রতিটি খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করাতে হবে নিখুঁতভাবে—আর সেটাই হয়েছে।
প্রেসিং-ফুটবলে ইন্টারকে বিধ্বস্ত করল পিএসজি
প্রথম মিনিট থেকেই বলের দখল এবং প্রেসিংয়ে দাপট দেখাতে থাকে পিএসজি। ইন্টারের রক্ষণভাগ ও গোলরক্ষক ইয়ান সোমার প্রবল চাপে ভুল করতে বাধ্য হন। প্রথম গোল আসে ১২ মিনিটে—ভিটিনহা ও দেজিরে ডুয়ের দুর্দান্ত পাসিং থেকে হাকিমির নিখুঁত ফিনিশ। যদিও তিনি গোলের পর উদযাপন করেননি, কারণ ইন্টার তাঁর প্রাক্তন ক্লাব।
এরপর প্রতিআক্রমণে পিএসজি দ্বিতীয় গোল পায়—দেম্বেলের ড্রাইভ ও চোখধাঁধানো পাস থেকে গোল করেন ডুয়ে। এরপর ইন্টার পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। প্রথমার্ধে বলের দখল ছিল ৬৩ শতাংশ পিএসজির কাছে, ইন্টার গোলের মুখও দেখতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধে আরও বিধ্বংসী রূপ
দ্বিতীয়ার্ধেও পিএসজি থেমে থাকেনি। ৬২ মিনিটে ডুয়ে তাঁর দ্বিতীয় এবং দলের তৃতীয় গোল করে জয় একপ্রকার নিশ্চিত করে দেন। ব্যাকহিল পাসে দেম্বেলে বল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভিটিনহাকে, যিনি নিখুঁতভাবে বল বাড়ান ডুয়েকে। মাত্র ১৯ বছর ৩৬২ দিনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে জোড়া গোল করে ইতিহাস গড়েন এই তরুণ।
৭৩ মিনিটে আসে চতুর্থ গোল—বাঁ প্রান্ত দিয়ে কাভারাত্স্কেলিয়া ড্রাইভ করে সোমারকে পরাস্ত করেন। ৮৬ মিনিটে সেনি মায়ুলু ম্যাচের পঞ্চম গোলটি করে ইন্টারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেন। এই জয়ের ফলে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফাইনালে ৫ গোলের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়লাভের রেকর্ড গড়ে পিএসজি।
রেকর্ড বইয়ের পাতা ওলটাল পিএসজি
এই এক ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একাধিক রেকর্ড ভেঙেছে পিএসজি:
১৬৮তম ম্যাচে প্রথম ট্রফি: ইউরোপিয়ান কাপসহ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১৬৮টি ম্যাচ খেলে পিএসজি শেষমেশ ট্রফি জিতল, যা এই প্রতিযোগিতায় প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড।দুই টিনএজার গোলদাতা: দেজিরে ডুয়ে ও সেনি মায়ুলু—দুই ১৯ বছর বয়সী তরুণ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোল করে নজির গড়েছেন।এক ম্যাচে তিন গোলে অবদান: ফাইনালে প্রথম তিন গোলেই ভূমিকা রেখেছেন ডুয়ে—একটি অ্যাসিস্ট ও দুটি গোল।ট্রেবল জয়: ঘরোয়া লীগ, কাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ—তিনটি ট্রফিই জিতে এনেছে পিএসজি, ইউরোপের নবম ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয়ের কীর্তি গড়েছে এবং প্রথম ফরাসি ক্লাব হিসেবে।একই কোচের ট্রেবল দুই ক্লাবে: লুইস এনরিকে দ্বিতীয় কোচ যিনি দুটি ক্লাবে ট্রেবল জিতেছেন—বার্সেলোনা (২০১৫) ও পিএসজি (২০২৫)। তাঁর আগে একমাত্র পেপ গার্দিওলা এই কীর্তি গড়েছিলেন।ডিফেন্ডারের রেকর্ড অবদান: হাকিমির এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৪ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট—মোট ৯টি অবদান, যা একটি মৌসুমে কোনো ডিফেন্ডারের জন্য যৌথভাবে সর্বোচ্চ।
ইন্টারের ম্লান উপস্থিতি
ইন্টার মিলানও গোটা টুর্নামেন্টে ভালো খেলেছিল। সেমিফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল তারা। কিন্তু ফাইনালে যেন একেবারেই হারিয়ে গিয়েছিল। তিনজন ৩৫ বছরের বেশি বয়সী খেলোয়াড় নিয়ে শুরুর একাদশে নামা ইন্টার সামলাতে পারেনি পিএসজির গতি ও পেশি। গোলরক্ষক সোমার একাধিকবার অস্বস্তিতে পড়েছেন পিএসজির প্রেসিংয়ের সামনে।
শেষ কথা: এই জয় এক নবযুগের সূচনা
পিএসজির এই জয় নিছক একটি ট্রফি জেতা নয়—এ এক দর্শনের জয়, এক পরিকল্পনার সার্থক পরিণতি। বড় নাম নয়, বড় স্বপ্ন ও টিমওয়ার্কে ভর করেই গড়ে তোলা এক দলই ইউরোপের সেরা হলো। ফ্রান্সের ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এবার থেকে ইউরোপীয় ফুটবল মানচিত্রে পিএসজি শুধুই ধনী ক্লাব নয়, তারা চ্যাম্পিয়নদের ক্লাব।
ম্যাচের হাইলাইটস