২০২৫ সালের ৭ই মে ভারতের ইতিহাসে এক নতুন সামরিক অধ্যায় রচিত হলো — অপারেশন সিন্দুর। এই নামেই ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের একাধিক স্থানে মিসাইল ও বিমান হামলা চালায়। ভারতের ভাষ্য অনুযায়ী, এই অপারেশন ছিল শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে এক নির্বাচিত এবং সীমিত প্রতিশোধমূলক অভিযান, যেখানে কোনো পাক-সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করা হয়নি। তবে পাকিস্তান দাবি করেছে, ভারতীয় হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিক, এমনকি শিশু ও নারী হতাহত হয়েছে।
কিভাবে শুরু হলো উত্তেজনা?
ঘটনার সূত্রপাত ২২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্র পাহেলগামে এক নির্মম জঙ্গি হামলায় ২৮ জন বেসামরিক নাগরিক, যাদের অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক, নিহত হন। দায় স্বীকার করে “দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট”, যেটি লস্কর-ই-তইবার একটি সহ-সংগঠন।
এই বর্বরতার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সিঁদুর নামের এই অপারেশনের পরিকল্পনা করে — নামটি প্রতীকী, কারণ পাহেলগামের হামলায় যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই স্বামী ছিলেন, এবং তাদের স্ত্রীদের সিঁদুর মুছে যাওয়ার অর্থেই এই নামকরণ।
অপারেশনের রূপ
২০২৫ সালের ৭ মে ভোররাতে, ভারতীয় বায়ুসেনা ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামক এক অভিযানে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর (মুজাফফরাবাদ ও কোটলি) এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরে মোট নয়টি স্থানে ২৪টি হামলা চালায়। এই হামলাগুলি নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত উভয় পার করেই পরিচালিত হয়।
ভারতের সরকার এই হামলাগুলিকে "নির্ভুল, পরিমিত এবং উত্তেজনা না বাড়ানোর মতো" বলে বর্ণনা করে। সরকার জানায়, কেবলমাত্র লস্কর-ই-তইবা ও জইশ-ই-মোহাম্মদ এর সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে এবং কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানা হয়নি।
ভারতীয় বায়ুসেনা এই অভিযানে রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে, যা SCALP ক্ষেপণাস্ত্র ও AASM হ্যামার বোমা দ্বারা সজ্জিত ছিল। ‘অপারেশন সিন্দুর’ মাত্র ২৩ মিনিট স্থায়ী হয়।
জইশ-ই-মোহাম্মদ দাবি করে, বাহাওয়ালপুরে ভারতীয় বিমান হামলায় তাদের নেতা মাসুদ আজহার-এর পরিবারের ১০ জন সদস্য নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৫ জন শিশু এবং আরও ৪ জন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল।
একজন পাকিস্তানি জেনারেল জানান, ভারতীয় বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ না করেই এই হামলা চালায়। মুজাফফরাবাদে বিস্ফোরণ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানান।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে স্থানীয়রা জানায়, প্রচুর যুদ্ধবিমানের গর্জন শোনা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী টুইটারে একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়, "ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে" – এবং #PahalgamTerrorAttack হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে হামলার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, পাকিস্তান ভীমবার গলি নামক একটি কাশ্মীরি গ্রামে গোলাবর্ষণ করে।পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ প্রথমে দাবি করেন, ভারতীয় সৈন্যদের আটক করা হয়েছে এবং কয়েকটি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। পরে পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাহার করে জানায়, কোনো ভারতীয় সৈন্য বন্দি হয়নি।
পাকিস্তান দাবি করে, ভারত এই হামলায় নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং শিশুদেরও হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় হামলায় মুজাফফরাবাদে অবস্থিত বিলাল মসজিদে আঘাত হানে বলে রয়টার্স জানায়।
বিবিসি নিউজ এক প্রতিবেদনে জানায়, মুরিদকে শহরে একটি শিক্ষা কমপ্লেক্সে (যেখানে স্কুল, কলেজ ও একটি মেডিকেল ক্লিনিক ছিল) আঘাত হেনেছে।ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করে, ভারত একটি পাকিস্তানি JF-17 যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
জাতিসংঘ: উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। চীন, জাপান ও রাশিয়া: উদ্বেগ প্রকাশ করে সামরিক উত্তেজনা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। ইসরায়েল: ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অপারেশনকে "লজ্জাজনক" আখ্যা দিয়ে দ্রুত শান্তি কামনা করেছেন।
দুই দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ছবি, ভিডিও এবং ভ্রান্ত তথ্যের ছড়াছড়ি চলছে।ভারতীয় পক্ষ বলছে, পাকিস্তান ভারতের সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করেছে—এমন ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে।পাকিস্তানি মিডিয়া বলছে, ভারতীয় প্রোফাইল থেকে গাজা ও লেবাননের ছবিকে পাকিস্তানে হামলার দৃশ্য বলে চালানো হচ্ছে।
অপারেশন সিন্দুর শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়—এটি ছিল এক রাজনৈতিক বার্তা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ, এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা। তবে এই উত্তেজনার ফলশ্রুতি যদি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়, তবে তা উপমহাদেশের জন্য হবে মারাত্মক। এখন সময়—পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক পথে ফিরে আসা ও শান্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া।